*** লাল রঙা ডায়েরি *** ---ফওজিয়া পারভীন।।

 


 খুব ছোট বেলায় বিয়ের পিড়িতে বসেছিলাম বাবা-মায়ের কথায়।বয়স তখন ১৪ বছর।আর যে মানুষটার সাথে আমার পথ চলা শুরু হয় উনার তখন ২৫ বছর।বর্তমানে আমরা দুজনেই বুড়ো-বুড়ির কাতারে চলে গেছি।কিন্তু আমাদের ভালোবাসার কমতি হয়নি।এখনো উনি আমাকে ফওজিয়া কে সংক্ষেপ করে ফৌজু বলে ডাকেন। আর আমি,ফাইয়াজের বাবা অথবা রাত্রির বাবা বলে ডাকি।
.
আমার যখন বিয়ে হয় তখন প্রেম- ভালোবাসা তো দূরের কথা বিয়ে মানে কি সেটাই বুঝতাম না। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে শুধুমাত্র বিয়ের দিন চুপচাপ ছিলাম।তাও অনেক কষ্টে।আমার খালাতো-চাচাতো ভাইবোনরা খেলছে দেখে আমারও খুব ইচ্ছে করছিলো খেলতে।
.
বিয়ের দিন শ্বশুড় বাড়ি এসে সব কান্নাকাটি বন্ধ করে দিলাম।নতুন জায়গায় নতুন বাড়িতে বেড়াতে আসছি মনে হচ্ছিলো তাই। আর ফাইয়াজের বাবার রোমান্টিক চোখের ভাষাটা তখন না বুঝলেও এখন মনে করে লজ্জা পাই, ভালোও লাগে।
.
আমার শ্বাশুড়ি আম্মার সাথে রান্না শিখতে আমি যখন রান্নাঘরে যেতাম বেচারা তখন কারণে অকারণে রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতো।আমি না তাকালে মুখ দিয়ে শব্দ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা সবসময়। বেচারার ভালোবাসা তখনও বোঝার ক্ষমতা আমার হয় নি। উনার স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগতো।বেচারা কতদিন মেঝেতে পা ঘষে ঘষে সংকেত দিয়ে আমায় ডাকতো।মাথায় দুষ্টমির কারণে সাড়া না দিয়ে উনাকে ভেংচি দিতাম।কত বড় পাগলিটাই না ছিলাম তখন।
.
দেখতে দেখতে সংসার জীবনের দু'টো বছর কাটিয়ে দিলাম।এরই মধ্যে আমাদের কোল জুড়ে ফাইয়াজ এলো।আমার চঞ্চলতা কমে গেল।আস্তে আস্তে সংসার,স্বামী, সন্তানের মাঝে নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিলাম।আর উনার ভালোবাসাটাও বুঝতে শিখে গেলাম। আসলে একজন নারীর মা হওয়া যে তার জীবনকে কতটা বদলাতে পারে তা আমি তখন বুঝতে পারি।
.
ফাইয়াজকে নিয়ে সে কি মাতামাতি সবার!আমার সেদিকে খেয়াল।কিন্তু উনি আমাদের মা-ছেলের সমান খেয়াল রাখতেন।কিছুক্ষণ পর পর বলতেন_ফৌজু, কেমন লাগছে তোমার? কি খাবে বলো?
সে কি উৎকন্ঠা উনার!আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম উনাকে।আর উনি পাগলি বউটা বলে আমার নাকটা টেনে দিতেন।
.
দেখতে দেখতে আমাদের মেয়ে সন্তান আসে ঘর আলো করে।উনি নিজেই বলেন রাত্রি ডাকবো আমাদের মেয়েকে। ততোদিনে আমার শ্বাশুড়ি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে যান।রাত্রি তখন ৪ মাসের ফুটফুটে বাচ্ছা। ওর তখন খুব অসুখ হয়। সবকিছু একা সামলে উঠতে পারছিলাম না। রান্নাচড়ানো হলো দেরিতে।সেদিন উনার অফিসের কাজে মাথা গরম ছিলো,আর রাগ ঝাড়লেন আমার উপর।কষে একটা থাপ্পড় ও দিয়েছিলেন। খুব কষ্ট লাগছিলো তখন। মনে মনে শুধু একটাই কথা উপরওয়ালাকে বলেছি,ভালোবাসা-সংসার কেনইবা আমাকে বুঝতে শিখালে আর আজ কেনইবা এতো অপমান আর কষ্ট দিলে।
.
সেদিনের পর যতদিন সে কষ্টের অভিমান চেপে ছিলাম,ততোদিন উনাকে নাম ধরে আতিক সাহেব বলে ডাকতাম। পরে যখন উনি আমার অভিমান ভাংঙ্গালেন তখন সুখে কেঁদেছিলাম।
.
আমাদের ফাইয়াজ এখন অনার্স করছে আর রাত্রি ইন্টারে পড়ছে।কিন্তু সংসারের টানাপোড়ন এ উনার আর আমার ভালোবাসায় কোন কমতি পড়েনি।
.
জীবনের এতোগুলো বছরের সারসংক্ষেপ লিখেছি আমার লাল রঙা ডায়েরিতে।আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। আমার লাল রঙা ডায়েরিটা আজ উনাকে উপহার দিলাম।পাগলটা খুশিতে সে কি কান্না!আজ আমারও চোখ ভর্তি জল তবে সেটা কষ্টের নয়,সেটা ভালোবাসার সুখের নোনাজল।।