যমজ। আগ্রহ জাগানিয়া শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো একই গর্ভজাত এবং একই সময়ে ভূমিষ্ঠ। তিন সন্তান হলে তাকে বলা হয় ‘ট্রিপলেট বেবি’। চারজন হলে ‘কোয়াড্রুলেট বেবি’। এর বেশি সন্তানও হতে পারে।
ট্রিপলেট বেবি মানে একসঙ্গে জন্ম নেওয়া তিন সন্তান নিয়ে এই লেখা। অক্সফোর্ডের ইংরেজি-বাংলা অভিধানে (কলকাতা থেকে প্রকাশিত) ট্রিপলেট কথার মানে দেখতে পাচ্ছি ‘একই সঙ্গে জাত একই মায়ের তিনটি সন্তান’। ট্রিপলেটের বাংলা কী হবে? জানতে চাই জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের কাছে। মনস্ক পাঠকেরা জানেন, প্রথম আলোতে স্যারের ‘আমার অভিধান’ মূল্যবান একটি রচনা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আনিসুজ্জামান বললেন, ট্রিপলেটের বাংলা হবে ত্রেতা বা ত্রৈত।
নাতনি চাই না, মেয়েকে বাঁচানআমার বড় মেয়েও সিজারিয়ান। দুই বছর পর এই তিন কন্যা একসঙ্গে জন্ম নিল। একসঙ্গে তিন তিনটা শিশু আমার পেটে, একথা শুনে আমার মা তো মহা আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি চিকিৎসককে বললেন, ‘আমার মেয়েকে সুস্থ করে দেন আপনি। যেভাবেই হোক, মেয়েকে বাঁচাতে হবে আগে।’ ওরা জন্মানোর পর আমার দুই বোন বলল তাদের একটা একটা করে দিয়ে দিতে। একজন নিঃসন্তান। আরেকজন কানাডায় থিতু। তিন ছেলে তার। সবাই বড়সড়। বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছে। সেই বোনের মেয়ের খুব শখ। খুব ঝোলাঝুলি করেছিল কোনো একজনকে নিয়ে নেওয়ার জন্য। হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন ট্রিপলেট বেবির মা মুনিয়া হাসান। পূর্ব গোড়ানে তাঁদের নিজস্ব বাড়ি। নাম অস্থায়ী নিবাস। কয়েক দিন আগে কথা হলো সেই তিন সন্তান মৌমিতা হাসান, মেহনাজ হাসান ও মেহরীন হাসানের সঙ্গে। বয়স তাদের ১৪ বছর। সবাই পড়ছে ক্লাস টেনে। দুইজন এক স্কুলে। অপরজনার স্কুল আলাদা। দুইজন বিজ্ঞান বিভাগে, একজন মানবিকে।
সুদক্ষ শল্যচিকিৎসায় মুনিয়া ও মেহেদী হাসান দম্পতির মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। দূর করেছিল সব উৎকণ্ঠা। সেটা ১৪ বছর আগের কথা। শাহজাহানপুরের প্যান প্যাসিফিক হাসপাতালে এই তিন বোনের জন্ম হয় ২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি।
মুনিয়া হাসান বললেন তাঁর ট্রিপলেট বেবি জন্ম দেওয়ার গল্প—গর্ভাবস্থায়ই ডাক্তার আমাকে জানিয়েছিলেন, প্ল্যাসেন্টা যেহেতু একটা, সুতরাং মেয়ে হলে তিনজনই মেয়ে হবে। আর যদি ছেলে হয়, তবে তিনজনই হবে ছেলে। ডাক্তারের কথাই ঠিক হলো শেষ পর্যন্ত। গর্ভাবস্থায় এক মাস আমাকে স্যালাইন নিতে হলো। একপর্যায়ে কোনো খাবারই ভালো লাগত না। আমাকে বলা হলো দুধ খেতে। দুধে সব ধরনের ভিটামিন আছে তো। সাড়ে আট মাসের সময় আমার গাইনোকলজিস্ট কনসাল্ট করলেন শিশুবিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। সাব্যস্ত হলো, এখন অস্ত্রোপচার করে ওদের বের করা হলে একজনকে ইনকিউবেটরে রাখতে হবে। সেটা এড়ানোর জন্য মোট সাতটি ইনজেকশন নিতে হয় আমাকে। জন্মানোর পর সবচেয়ে ছোটজনকে নল দিয়ে খাওয়াতে হতো কিছুদিন। বুকের দুধ ওদের দিতে পারিনি। সেটা সম্ভব ছিল না তখন।
আরও তথ্য জানতে চাই মুনিয়া হাসানের কাছে। চার মাসের সময় বলা হলো বাচ্চা হবে যমজ। ছয় মাসের সময় যখন শুনলেন ওরা তিনজন, তখন খুবই ভয় পেলেন। মুনিয়া বললেন, আমার বড় মেয়েও সিজারিয়ান। একই ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে তারও নির্ঝঞ্ঝাট জন্ম।
তিন কন্যার নাম রাখা হলো সিঁথি, রীতি ও প্রীতি। তিন বোনে ঝগড়াঝাঁটি মাঝে মাঝে হয়। দু’জনের চেহারা ও খাদ্যরুচি প্রায় একই রকম। অন্যজন একটু আলাদা। তিন মেয়ের জন্য আগে একই ধরনের পোশাক কিনতেন। এখন কিনতে হয় আলাদা আলাদা। ওর বলে, তিনজনের ড্রেস আলাদা হলে লোকেরা আমাদের চেহারার মিল সহজে বুঝতে পারবে না। রাস্তাঘাটে ওদের চেহারার মিল দেখে লোকজনের অতিমাত্রায় কৌতূহলে ওরা অস্বস্তি বোধ করে। লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। আমরা চট্টগ্রামে যে বাড়িতে থাকতাম, সেই বাড়িওয়ালার ছিল যমজ বাচ্চা। ওই বাড়িতে থাকতে থাকতেই আমার তিন–তিনটা বাচ্চা হলো একসঙ্গে।
তিন কন্যার বাবা মেহেদী হাসান পেশায় একজন কেমিস্ট। একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করছেন। তিনি বললেন, মেয়েরা আমার বড় লক্ষ্মী। আমি মেয়েদের ঘর সংসারের কোনো কাজ করতে দিই না। ওদের মা অবশ্য কাজ শেখাতে চায়। জোরাজুরিও করে কোনো কোনো সময়। ওদের জন্মের আগে শুধু একটা ব্যাপারেই বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। কেউ না আবার অসুস্থ হয়ে জন্মায়। তেমন কিছু ঘটেনি।
বেণি দোলানো তিন বোনের সঙ্গে কথা হলো। আদুরে আদুরে মিষ্টি দেখতে তিনজনাই। লাজুক স্বভাবের। ওরা আমাকে বলে, রাস্তায় লোকে যমজ যমজ বলে সব সময় মন্তব্য করে। ঠায় তাকিয়ে থাকে। এসব আমাদের মোটেও ভালো লাগে না। সে জন্য আমরা পারতপক্ষে বাড়ির বাইরে বিশেষ একটা বের হই না। বড়জন সিঁথি বড় হয়ে ডাক্তার হতে ইচ্ছুক। দ্বিতীয়জন রীতির স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ার হবে। একেবারে ছোটজন শিক্ষকতাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চায়। তিন বোনেরই চোখে চশমা। ওদের বাবা জানালেন, চোখের সমস্যা ওদের জন্মগত। ডাক্তার বলেছেন, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর ওদের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করাতে হবে। তা–ই আমরা করছি। তিন বোনেরই খুব পছন্দের খাবার হলো বিরিয়ানি ।
সাগরপারের তিন ভাই আসিফ নূর চৌধুরী ও নীলিমা জাহিদ সুলতান দম্পতি। এঁদের নিবাস কক্সবাজার। বিয়ের পর বাচ্চা হচ্ছিল না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ ছিল বেশ। একসঙ্গে তিন সন্তান মাতৃগর্ভে এল। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ভূমিষ্ঠ হতে হলো তাদের। মাতৃজরায়ুতে অবস্থানের সময় ৭ মাস ২ দিন। মাত্র ৪ মিনিটে ডেলিভারি করানো হলো তাদের। সিজারিয়ান সেকশন। তিন জনের সম্মিলিত ওজন চার কেজি। মাটির পৃথিবীতে এসে ভালো রকম বিপদেই পড়তে হয়েছিল তাদের। ইনকিউবেটরে থাকতে হয়েছে টানা ২০ দিন।
তিন ভাইয়ের নাম যথাক্রমে আকিক নূর চৌধুরী, আমল নূর চৌধুরী ও আলাপ নূর চৌধুরী। তারা এখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ে। সবার জন্ম ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি। ওদের বাবা আসিফ নূর একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ও বিপণন ব্যবস্থাপক। মা চাকরি করতেন ব্র্যাকে। তিন ছেলেকে লালন-পালনের জন্য চাকরি ছাড়তে হয়েছে।
আসিফ নূর তিন পুত্র অর্থাৎ ট্রিপলেট বেবি সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানালেন। তাঁদের আর কোনো সন্তান নেই। ওদের জন্মের চার মাস আগে জানা গেল তিনজনের কথা। তিন ছেলের জন্ম হয়েছে চট্টগ্রামের রয়্যাল হসপিটালে। মা এ সংবাদ শুনে খুবই খুশি হয়েছিলেন। তখন তার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে কত বড় দায়দায়িত্ব কাঁধে বর্তাচ্ছে। আসিফ নূর বললেন, ‘আমি তখন ছিলাম ঢাকায়। ফোনে খবরটা জেনে বেশ উৎফুল্ল হই। নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হয়। আমিও দায়িত্বের ব্যাপকতা ও চ্যালেঞ্জটা গোড়ার দিকে অতটা আঁচ করতে পারিনি। একসঙ্গে তিন বাচ্চা বড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তাতে মায়ের কষ্টটাই সবচাইতে বেশি। ওরা মায়ের বুকের দুধ পান করে বড় হয়েছে। পালাক্রমে ওরা মায়ের দুধ পান করত। জন্মের ক্রমানুসারে ওদের মধ্যেকার বড় ছোট নির্ধারণ করেছি। তিনজন দেখতে হুবহু এক নয় বলে সুবিধা হয়েছে।’
এই তিন ভাইকে লালন–পালনে কোনো সমস্যা হয় কি? আসিফ নূর বলেন, একটু গাদাগাদি হয় বৈকি! যথাযথভাবে মানুষ করার ব্যাপারটি বেশ ব্যয়বহুলও বটে। ওদের কোনো বড় ভাই কিংবা বোন থাকলে বেশ হতো। এরা তিনজন তো সমানে সমান। একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কে কাকে মানবে? দিনমান ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। এই ঝগড়া অবশ্য তাদের নিত্যদিনের খেলার অংশই হয়ে গেছে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে আবার মিলমিশও কম না। একজন আরেকজনকে না দেখে থাকতে পারে না। একসঙ্গে থাকে সব সময়। দল বেঁধে স্কুলে যায়। খেলাধুলা করে। খাদ্যরুচিও এক নয় তাদের। তিন ভাই–ই যেটা পছন্দ করে, তা হলো মুরগি ও বড় চিংড়ি মাছ। অন্য খাবারের বেলায় একেক জনের পছন্দ একেক রকম। দুইজন নিজের হাতে খেতে পারে। একেবারে ছোটজন এখনো মায়ের হাতে খায়। জামাকাপড় সব সময়ই যে এক রকম দিতে হয়, সেটা না। তিনজনের পছন্দের রংও আলাদা। তারা তিনজনই শিল্পী। ছবি আঁকতে ভালোবাসে। সবকিছুকেই তারা রং দিয়ে বিচার করতে ভালোবাসে। যেমন একজন বলল, ‘বাবা তোমার মোটরসাইকেল কি গুন্ডারা নিয়ে গেছে?’ রসিকপ্রবর পিতৃদেব জানতে চাইলেন, ‘গুন্ডার রং কী হবে বলো তো?’ চটপট উত্তর দেয় তারা, গুন্ডার রং হবে চকলেট। চিত্রশিল্পী উত্তম সেনকে একবার তারা প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা কাকু, বলেন তো দুঃখের রং কী? উত্তম সেন উত্তর দিয়েছিলেন, দুঃখের রং হলো ছাই।
নীলিমা জাহিদ সুলতান বললেন, ‘লোকজন বলে, আপা আমরা একটাকেই পালতে পারি না। আর আপনার তো তিন তিনটা! তিনজন নিয়ে আমার কষ্টও বেশি। এরা ঝগড়াঝাঁটি করে, সামলানো মুশকিল। আবার মিলেমিশেও থাকে। পরস্পরের জন্য টান আছে খুব। যৌথ পরিবার আমাদের। তিন বাচ্চার জন্মের পর ব্র্যাকের চাকরিটা আমাকে ছাড়তে হয়েছে।’
মা–বাবা কার প্রতি টান বেশি ওদের? আসিফ নূর এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, বাবা-মা দু’জনের জন্যেই টান আছে ওদের। তিন ভাই টিভিতে খেলা দেখতে পছন্দ করে। প্রিয় খেলা ক্রিকেট, ফুটবল আর রেসলিং। ট্যাবে তারা গেমস খেলেও সময় কাটায়। তিনজনের মধ্যে বেশ ভালো দোস্তি রয়েছে। পড়াশোনায় তিনজনই মোটামুটি ভালো।