অতিথি নারায়ণ || হাস্যরসাত্মক গল্প পরে মজা পাবেন


একটি স্কুলে চাকরি করি। সেই সুবাদে প্রায় অপ্রত্যাশিত ছুটিছাঁটা পাওয়া হয়ে যায়। এই যেমন গরমের ছুটি, শীতের ছুটি, বর্ষার ছুটি, বসন্তের ছুটি লেগেই আছে। করপোরেট জগতের অন্য বন্ধুরা আমার ছুটির এহেন বহর দেখে হিংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে প্রায়ই গালিগালাজ করে। স্কুলে মিড টার্মের পরেই এ রকম ১০ দিনের একটা ছুটি পাওয়া গেল। আমিও বেশ কিছু মুভি নামিয়ে, কিছু গল্পের বই কিনে কোমরে লুঙ্গি বেঁধে ছুটি উপভোগের জন্য প্রস্তুত হলাম। ছুটির প্রথম দিনে ঘুম ভাঙল তীক্ষ কলিংবেলের শব্দে। কানে বালিশচাপা দিয়েও রক্ষা নেই, বেল বেজেই চলছে। মোবাইলে দেখি সকাল ৭টা। ‘এই ৭টা বাজে কোন হালায় এলো’—গজগজ করতে করতে দরজা খুলতেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। গ্রাম থেকে গেদু চাচা এসেছেন। পান খাওয়া লাল দাঁত দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘বাজান আছ কেমুন?’

আমি ঢোক গিলে বললাম, ‘ভালোই ছিলাম চাচা।’
তিনি বাসার ভেতরে পা দিয়েই বিশাল দুটি হাঁস কার্পেটের ওপর রেখে দিলেন। ওরা দুজনই মনে হয় অনেকক্ষণ ধরে টয়লেট চেপে রেখেছিল। আমাদের লাল রাজকীয় কার্পেট দেখে ওরা পিচিক পিচিক করে কাজ সেরে ফেলল। এরই মধ্যে আমাদের কাজের ছেলে মতি চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে এলো। কার্পেটের ওপর হাঁস আর হাঁসের মল দেখে সে আঁতকে উঠল, ‘আরে করছেন কী বাইজান? আম্মায় দেখলে তো সাড়ে সর্বনাশ!’

চাচা বললেন, ‘এই বেডা তুই কেডা? এইসব ভিত্রে নিয়া যা, আর এক গেলাস ঠাণ্ডা ফানি আন। ভ্যানভ্যান করস ক্যান?’

মতি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। আমি হাঁসগুলোর দিকে তাকালাম। হাঁসগুলো আমাদের বিশাল টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকল।

আমি রুমে ঢুকে ফেসবুক থেকে আমার স্ট্যাটাস সরিয়ে ফেললাম। নিশ্চয়ই সবার নজর লাগছে। না হলে এই সময় ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’ গেদু চাচা কেন এলো! এর আগে একবার তিনি সাত দিনের জন্য এসেছিলেন। জীবন ছেড়াবেড়া করে দিয়ে গেছেন।

আমি বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। এপাশ থেকে ওপাশ ফিরতেই দেখি গেদু চাচা এসে হাজির, ‘কী ব্যাপার ভাতিজা। এই অবেলায় ঘুমাইতেছ ক্যান? অবেলায় ঘুমাইলে তো স্বাস্থ্য খারাপ হইয়া যাইব। আমারে দেখো! এই বয়সেই ভোর চাইরডায় উঠি। মনে রাখবা, স্বাস্থ্যই হইলো ধন।’

আমি ধন আর সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে উঠে পড়লাম। আব্বা-আম্মার রুমে গিয়ে বললাম, ‘গেদু চাচা আসছে কেন?’



আম্মা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে বলল, ‘এইসব কী কথা! উনি চিকিত্সা করাতে আসছেন।’ ‘ওনাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিত্সা করাতে বলো। টাকা যা লাগে আমি দেব।’

আব্বা রেগে গিয়ে বলল, ‘কী উল্টাপাল্টা কথা বলতেছস? উনি এখানে থাকবে ওনার মতো। তোর সমস্যা কী? যা, রুমে যা।’

আমি রুমে গিয়ে বিষণ্ন বদনে বসে আছি। সকাল বাজে সাড়ে ৭টা। গভীর রাত পর্যন্ত মুভি দেখছি। ভাবছিলাম, দুপুর পর্যন্ত ঘুমাব। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। রুমে মতি এসে বলল, ‘ভাই, কাম সারছে!’

‘কী হইছে?’

‘গেদু চাচা নাকি আপনার গোসলখানা ব্যবহার করব।’



‘ক্যান, গেস্টরুমেরটা কী হইছে?’

‘ওইটার কল নষ্ট।’

‘কল নষ্ট, এত দিন ঠিক করাস নাই ক্যান?’ আমি চেঁচিয়ে বললাম। খানিক বাদেই গেদু চাচা হাজির। গামছা, লুঙ্গি, সাবান, তেল—বিশাল আয়োজন, ‘বাজান, তোমার কাছে গ্যাস্ট্রিকের দাবাই আছে? প্যাটে কিমুন গ্যাস হইছে।’

এই বলে গেদু চাচা আমার বাথরুমে ঢুকে পড়ল। আর তার পেটে যে আসলেই গ্যাস হইছে, সেটা নানা শব্দ করে বোঝাতে লাগল।

‘বুইড়া বেডা করে কী?’ এই সব শব্দ শুনে অবাক মতিও।

গেদু চাচা বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর বাথরুমে গোটা অর্ধেক এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে তবে রক্ষা।

নাশতার টেবিলে গেদু চাচা গোটা চারেক পরোটা, এক বাটি মাংস, একটি সিদ্ধ ডিম, দুই পিস সাগর কলা খেয়ে বলল, ‘বয়স হইয়া গেছে, আগের মতো খাইতে আর পারি না।’ এই শুনে মতি হাত থেকে গ্লাস ফেলে দিল।

‘এই বেডা করছ কী? সাবধানে চল।’

এর মধ্যেই পাশের বাসার তিন্নি এলো। তিন্নি মেয়েটার সঙ্গে আমি একটা সম্পর্ক ধীরে ধীরে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। মেয়েটা ভার্সিটিতে পড়ে। আমার থেকে প্রায়ই গল্পের বই নিতে আসে। এভাবে বই আদান-প্রদানের মধ্যেই সম্পর্ক করার চেষ্টা। এর মধ্যেই সে এলে গেদু চাচা দরজা খুলে দিল।

‘রায়হান ভাইয়া আছে?’ গেদু চাচাকে তিন্নি জিজ্ঞেস করল।

‘রায়হান তো টাট্টিখানায়। মনে হয় হাগতাছে। তুমি কে গো মা?’

পুরো ঘটনা দেখে মতি দৌড়ে গিয়ে আমার বাথরুমের দরজায় নক করল, ‘বাইজান তুরন্ত বাইর হন। গেদু চাচা তিন্নি আফারে কী কয় দেইখা যান।’

আমি কোনোভাবে কাজ সেরে বের হয়ে গেদু চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মেয়েটা কই?’
‘চইলা গেছে। আমি কইছি তুমি টাট্টিখানায়!’
আমি রুমে গিয়ে মতির থেকে সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। তিন দিনের মাথায় যখন গেদু চাচার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম, তখনই আমি আর মতি এক প্ল্যান করলাম। গভীর রাতে ওনাকে ভূতের ভয় দেখাতে হবে। গত পহেলা বৈশাখে মেলা থেকে কেনা ভূতের মুখোশটা বের করলাম। মতিকে সব বুঝিয়ে বলতেই মতি বলল, ‘বাইজান, বুইড়া বেডা। ফট কইরা মইরা গেলে?’


‘তাহলে তো বেঁচেই গেলাম, মতি। যা, কথা বাড়াইস না।’


রাত ৩টায় মোবাইলে একটা মেয়ের কান্নার সুর গেদু চাচার রুমে গিয়ে বাজাতে লাগলাম। একটু পর চাচা উঠে ‘এই কেডা, এই কেডা’ বলে লাইট জ্বালাতে গেল। কিন্তু লাইট আগেই খুলে নেওয়া হয়েছে। বারান্দার জানালায় মতি সেই মুখোশ পরে ছোট্ট একটি টর্চ জ্বালিয়ে নিজের মুখ দেখাতে লাগল। চাচা জোরে জোরে কী যেন পড়ছে। আমরা সরে পড়লাম। যথেষ্ট হয়েছে। পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে চাচাকে দেখেই বুঝলাম সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। আমি আর মতি একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছি, এর মধ্যেই কলিংবেল। উঠে দেখি এক হুজুর টাইপ ছেলে।


‘গেদু চাচা আছে?’
‘তয়োব আইছ?’ এই বলে গেদু চাচা সেই ছেলেকে ঘরে নিয়ে এলো।
গেদু চাচা আব্বাকে বলল, ‘এইটা আমাগো গেরামের পোলা। তোমাদের এই বাসায় খারাপ জিনিসের আছর আছে। তয়োব এইসব ব্যাপারে ওস্তাদ। সে আগামী কয়েকটা দিন আমার লগে থাকব।’
মতি বিড়বিড় করল, ‘কাম সারছে!’



আব্বা বলল, ‘সমস্যা নাই।’
ঠিক সেই সময় হকার পেপার দিয়ে গেল। হেডলাইন বলছে, ‘রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে চাইছে না!’