সকালবেলা। সবে চায়ের পেয়ালাটি হাতে নিয়ে বাইরের ঘরে এসে বসেছি, সঙ্গে সঙ্গে একদিকে খোলা জানালা দিয়ে পড়ল পরপর দুখানা খবরের কাগজ, অন্যদিকে সদরের নাম-ঘণ্টাটা করে উঠল করর করর।
তারপরই এসে ঢুকলেন কিশোরীবাবু। মেজো কাকার বন্ধুত্বসূত্রে রোজই আসেন তিনি। দুই কাপ চা খেয়ে এবং খবরের কাগজখানা উল্টেপাল্টে দেখেই চলে যান। যেদিন বাড়ি থাকি, এটা-সেটা নিয়ে গল্প ফাঁদেন। সেদিন বেরিয়ে যাই, একাই বসে বসে পাঠ ও পান সেরে চলে যান।
আজ আছি, তাই আমাকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ডিগবয় গিয়েছিলে? চমত্কার জায়গা।
বললাম—কোনো সময় গিয়েছিলেন বুঝি?
কিশোরীবাবু বললেন—শুধু যাওয়া? ডিগবয় তিনসুকিয়া নাহরকাটিয়া মার্গারিটা সব তো তৈরি হলো আমারই চোখের ওপর। কী ছিল আগে ওসব জায়গায়? শুধু বন, পাহাড় আর তাতে বাঘ, হাতি, গণ্ডার ও পাইথন। ওখানে যে তেল আছে, আর সে তেল যে কোটি কোটি টাকার সম্পদ, এ কে জানত?
ততক্ষণে চা এসে গেছে। পেয়ালায় গোটা দুই চুমুক দিয়ে কিশোরীবাবু বললেন—একটিমাত্র মানুষের বুদ্ধিতে এত বড় সোনার খনি আবিষ্কার হয়েছে, আর তার পেছনে ছিলেন একটি বাঙালি যুবক।
কৌতূহলী হয়ে বললাম, কী রকম? বলুন তো শুনি একটু।
কিশোরীবাবু একটানা তিন-চার চুমুক চা গলাধঃকরণ করে বললেন—ফেয়ারবোর্ন সাহেবের নাম শুনেছ তো? তিনি ছিলেন বিখ্যাত শিকারি। আসামে এসেছিলেন হাতির দাঁত ও বাঘের চামড়ার ব্যবসা করবেন বলে। গৌহাটিতে ছিল তাঁর অফিস, আর সেই অফিসের হেডক্লার্ক ছিলাম আমি।
তারপর?
তারপর ইতিহাসের দেবতা অদ্ভুত কাজ করিয়ে নিলেন দুজনকে দিয়ে। অথচ অকৃতজ্ঞ ইতিহাস দুজনকেই কেমন ভুলে গেছে দেখ। ফেয়ারবোর্ন ইংরেজ সন্তান, তিনি তবু লাখ দুই টাকা বাগিয়ে নিয়ে দেশে গেলেন, আর আমি স্রেফ গলাধাক্কা খেয়ে রিক্ত হস্তে কলকাতায় এসে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছি আজ ২২ বছর।
কিশোরীবাবু গল্পের এখানেই গলদ। তিনি যা নিয়েই কাহিনি ফাঁদুন, শেষ পর্যন্ত তা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর আপন জীবনী। তখন তাঁকে মোড় ফিরিয়ে দিতে হয়, নইলে মূল গল্পটা একেবারে মাঠে মারা যায়।
আস্তে আস্তে বললাম—হ্যাঁ, এবার বলুন ডিগবয় শহর তৈরির ইতিহাস। খুব আগ্রহ হচ্ছে শুনতে।
কিশোরীবাবু বললেন, হ্যাঁ গো, তাইতো বলছি। আচ্ছা, ডিগবয় কথাটা লক্ষ করেছ ভালো করে? ডিগ আর বয়, তার মানে বাচ্চা লোক খোঁড়। কিন্তু কী খুঁড়বে? কে বলল এই কথা? কেন বলল? সেটাই হলো ইতিহাস... শোন বলছি।
এই বলেই হাত বাড়ালেন তিনি। খবরের কাগজের ভেতরের অংশটা তাঁকে ধরিয়ে দিলাম, আর বাইরের অংশটা তাঁর হাত থেকে নিয়ে বললাম—বলুন কাকাবাবু।
কিশোরীবাবু বললেন—সেটা বোধ করি জানুয়ারির শেষ কি ফেব্রুয়ারির গোড়া। হঠাত্ সাহেবের শখ হলো শিকারে যাবেন। সার্কাসের জন্য একটা জ্যান্ত ভালুকের, আর একটা অজগরের চামড়ার অর্ডার এসেছিল বিদেশ থেকে। আসল কারণ অবশ্য সেটাই।
সাহেব বললেন—কিশুরী, বি রেডি ম্যান। আমি সোমবার সকালেই রওনা হব।
বহুত আচ্ছা সাহেব, বলে তোড়জোড় শুরু করে দিলাম। তারপর দুজন আর্দালি, জঙ্গল ঠেঙানোর লোক ছয়জন, দুটি হাতি আর বন্দুক ও খানাপিনার পুঁজি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সোমবার ভোরে। এখন যেখানে তেল শোধনের কারখানা, সেখানে তাঁবু পড়ল দুপুর নাগাদ। সাহেব ঘোড়ায় আসবেন, তাঁর আসতে তাই বিকেল হয়ে যাবে।
রান্নাবান্না হচ্ছে। আমার তো জানোই, চিরদিন পড়ুয়া স্বভাব, একখানা বই খুলে একটা মেহগিনিগাছের নিচে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছি। হঠাত্ বেজে উঠল ঢোল ডগর এবং ফটাফট বন্দুকের আওয়াজ হলো তাঁবুর এপাশ-ওপাশ থেকে।
ভারি জমে গিয়েছিলাম বইখানা নিয়ে। বিরক্ত হয়ে উঠে এলাম। হাঁপাতে হাঁপাতে পিয়ন পানিগ্রাহী বলল—হাতি বাবু জংলা হাতি। এখনি তাঁবুফাঁবু তছনছ করে দিত। তাই সবাই মিলে খেদিয়ে দিলাম তাকে। ঢুলিদের নিয়ে গিরিধারী জঙ্গলে গেছে বন্দুক হাতে তাকে পিছু তাড়া করে। নইলে ফের যদি ফিরে আসে।
বইয়ের নেশা ছুটে গেল। জংলা হাতির স্বভাব তো আমি জানি। ভীষণ গোঁয়ার ওরা। আর কিছুই ভোলে না। যার ওপর রাগ হয় তাকে খতম করবে নয়তো নিজে খতম হবে, তবেই ছাড়বে।
বললাম—একটানা অনেকক্ষণ ফাঁকা আওয়াজ করো বন্দুকের। তা হলেই ঘন বনে ঢুকে পড়বে।
চারটের একটু আগে সাহেব পৌঁছলেন। তাঁর সাদা টাট্টুর পিঠে মস্ত এক টোটার বাক্স।
আমাকে বললেন—খাওয়া হয়েছে কিশুরী?
বললাম—হ্যাঁ সাহেব, আপনার অনুগ্রহে।
আমার পিঠে আলতো করে একটা থাবা মেরে ফেয়ারবোর্ন বললেন—সব ঠিক আছে তো? কাল কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই...
আমি বললাম—বহুত আচ্ছা। তার পরেই আমতা আমতা করে বুনো হাতি বেরোনোর ঘটনাটা বললাম।
সাহেব সঙ্গে সঙ্গে বললেন—কাম এলং কিশুরী। চলো হাতি আসার পথটা একটু পরীক্ষা করে দেখি। তাহলে এই পথ ধরেই এগোতে সুবিধা হবে। তা ছাড়া...
দুজনে চলেছি। বন্দুক হাতে সাহেব আগে আগে, পেছনে আমি। বুক দুরদুর করছে।
হঠাত্ দেখলাম, মাটিতে গোল গোল পায়ের ছাপ। হাতির পা ওটা, বুঝতেই পারছ। কিন্তু শুকনো মাটির ওপর তেলতেলে হয়ে রয়েছে কেন ছাপগুলো?
বললাম—স্যার স্যার, দেখুন, অয়েলি অয়েলি ফুটপ্রিন্টস অব দি এলিফ্যান্ট। হাতির তেলতেলে পায়ের ছাপ।
সাহেব ঝুঁকে দেখলেন। একটা দাগে আঙুল ঘষে সেটা নাকের কাছে বার দুই ধরলেন। তারপর বললেন—কিশুরী, আনটোল্ড ওয়েলথের অকল্পনীয় ঐশ্বর্যের নিশানা মনে হচ্ছে এগুলো। চলো গভীরে, শিকারের চেয়ে অনেক বড় কাজই হয়তো সামনে এসে পড়েছে। কিন্তু চুপ, কেউ যেন না জানে।
ওই চিহ্ন ধরে দুজনে মাইল দুই চলে গেলাম পাহাড়, জঙ্গল ও কাঁটা খোঁচা গ্রাহ্য না করে। তার পরই চারদিকে পাথুরে প্রাচীরের মাঝে একটা ফাঁকা মতো জায়গায় দেখলাম ঝর্ণার মতো বেগে ফিনকি দিয়ে ঠেলে উঠছে একটা তরল জিনিস এবং তা থেকে আসছে কেমন একটা ভোঁটকা গন্ধ।
বললাম—হোয়াটস দিস্ সাহেব? এটা কী?
সাহেব বললেন—পেট্রল! এই খনিজ তেলে মোটর চলে, এরোপ্লেন চলে। দূরপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, আর রাশিয়ায় আছে এই সম্পদ। দেখা যাচ্ছে, আছে ভারতেও।
তার পরেই বললেন—আমরা কোটি কোটি টাকা কামাব এই থেকে। গলাটা কেঁপে উঠল তাঁর উত্তেজনায়।
পরদিন সকালে একজন কুলি লাগান হলো আশপাশ থেকে জোগাড় করে এনে। সে গাইতি কোদাল নিয়ে খুঁড়তে লাগল, আর ফেয়ারবোর্ন সামনে দাঁড়িয়ে হাঁকতে লাগলেন ডিগবয়, ডিগ! এই ডিগবয়ের আদি পর্ব বুঝলে।
তারপর কী হলো, জিজ্ঞেস করলাম আমি। পকেট থেকে কৌটা বের করে একটি পান সশব্দে মুখে পুরে কিশোরীবাবু বললেন—কী আর হবে? খবর পেয়ে গভর্নমেন্ট এসে আগলে বসল। সাহেবকে ভিড়তেই দিল না আর ধারেকাছে। কিন্তু ইংরেজ বাচ্চা তো! ঢের লেখালেখি করে ওই টাকাটা আদায় করলেন তিনি। আর এই শর্মারাম, গরিবের ছাওয়াল, শুধু হাতে ঘরে ফিরল।
এই পর্যন্ত বলেই কিশোরীবাবু ভাঁজ করা কাগজের বাকিটা ফেরত দিলেন এবং ছাতাটা বগলে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
ছোট ভাই মোহিনী মুখে একটা বিদ্রুপের আওয়াজ করে বলল—সব বাজে কথা! একেবারে বোগাস!