পিকিউলিয়ার কন্ডাক্টর সিনড্রোম


আমার বিয়ে বেশিদিন হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই আমি গণ্ডগোলের গন্ধ আঁচ করতে পেরেছি। আমার বউয়ের নাম ইন্দিরা। ওর একটা অদ্ভুত রোগ আছে, যেটা বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ জানায়নি। বিয়ের কিছুদিন পর নিজে থেকেই জানতে পেরেছি। রোগের নামও অদ্ভুত, পিকিউলিয়ার কন্ডাক্টর সিনড্রোম। মানে, আমার বউ থেকে থেকে বাসের কন্ডাক্টরের মতো আচরণ করে। অবচেতন মনেই। সেটাও আমি বুঝতে পেরেছি।

প্রথম যেদিন টের পেলাম, সেদিন আমাদের ফুলশয্যা। আমি ঠিক করেছিলাম ওকে সহজ হওয়ার জন্য সময় দেব। ফুলশয্যার রাতে দু-একটি কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ব। সারা দিনের খাটাখাটুনিতে দুজনেই ক্লান্ত থাকব। সেটাই বরং ভালো হবে। আমি সেই মতো সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে বিছানায় বউয়ের পাশে এসে বসলাম। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে শেষে বললাম—‘তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে আছ?’

ইন্দিরা মাথা নাড়ল। আমিই আবার বললাম, ‘তাহলে শুয়েই পড়ো, নাকি?’ ইন্দিরা বোধ হয় বুঝল যে ওরও দু-একটি কথা বলা উচিত। ও ইতস্ততভাবে বলল, ‘না না, কথা বলুন না।’

আমি এক মিনিট ভেবে বললাম, ‘তুমি সহজ হতে পারো আমার সঙ্গে। আমাকে আপনি করে বলতে হবে না। আমাকে তোমার বন্ধু ভাবতে পারো নিঃসন্দেহে। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে পারো। মানে ফ্রাংক হতে পারো।’

ইন্দিরা লাজুক মুখেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে উঠল, ‘কই আপনারটা দেখি।’

এই আমি যে আমি এতক্ষণ ফ্রাংক হওয়ার ব্যাপারে এত কথা বললাম, সেই আমিও লজ্জা পেয়ে গেলাম। কোনো রকম বললাম, ‘মানে আজকেই! মানে এত তাড়াতাড়ি না করলেও হবে।’

ইন্দিরা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি জেগে রইলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে শেষে হতাশ হয়ে ভোর ৪টার সময় ঘুমাতে গিয়েছিলাম। তখন কি আর জানতাম ইন্দিরা আমার কাছে টিকিট চাইছিল, অন্য কিছু না। যাকগে। আমার তাড়া ছিল না বাপু।

তখনো কিছু আন্দাজ করতে পারিনি। ইন্দিরা আমার সঙ্গে তেমন কথা বলত না। ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলত। মাঝেমধ্যে মনে হতো আমার বউ হয়তো বোবা। তাতে অবশ্য আমার খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না।

মুখ খোলে না, খোলে না, কিন্তু যেদিন মুখ খুলল সেদিন গোটা বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেল। প্রথমেই বলে রাখি, আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। এই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে যখন সবাই আলাদা আলাদা কক্ষপথে নিজস্ব পেয়ার তৈরি করে ইলেকট্রনের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন আমার বাবা আর জেঠা সিদ্ধান্ত নেয়, তারা একসঙ্গে থাকবে আমাদের পৈতৃক ভিটায়। আমিও তাই আমার জেঠতুতো দাদার সঙ্গেই বড় হয়েছি। আমাদের মধ্যে বেশ মিলমিশ। ভালোবাসা।

যা হোক, কথা থেকে সরে যাচ্ছি। আমাদের এই পুরনো বাড়িতে একটাই সমস্যা, আর সেটা হলো বাথরুম। গোটা বাড়িতে মাত্র দুটি বাথরুম। একটি বাড়ির বাইরের দিকে। সেটায় খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাই না। বাড়ির মধ্যে যে বাথরুমটি আছে, সেটাই সবাই ব্যবহার করি। ইন্দিরা সেদিন স্নান করতে ঢুকছিল, হঠাত্ আমার জেঠা পেটে হাত দিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলে, ‘বউমা, তুমি একটু বাইরেরটায় যেতে পারবে? আমার ভীষণ ইমার্জেন্সি।’

আমার জেঠা সরল মানুষ। সরল মনেই কথাটা বলেছিল। সে আর কী করে জানবে আমার বউ প্রত্যুত্তরে ‘আচ্ছা’ না বলে বলবে, ‘চলুন চলুন,  ভেতরে চলুন। আরো একজনের জায়গা হবে।’

কথাটা শুনেই তো আমার জেঠা অবাক হয়ে গেল।

এই ঘটনাটা আমাদের বাড়িতে আমাশয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল। জেঠা এরপর আর কোনো দিনই ইন্দিরার মুখোমুখি হওয়ার সাহস দেখায়নি। বেশ কয়েক দিন আড়ালে ছিল। ইন্দিরাও দরজায় খিল তুলে বসেছিল। সবাই আড়ালে কথা বলতে শুরু করেছিল। ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগল। ইন্দিরার সঙ্গে আমার অল্প দিনের পরিচয় হলেও সে আমার বউ। তা ছাড়া ইন্দিরা এ রকমভাবে বললই বা কেন! সেটা জানাও প্রয়োজন। আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে সরাসরি ওকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা তুমি সত্যিই জ্যাঠাকে ওই কথাটা বলেছ?’

ইন্দিরা নিরুত্তর।

আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ‘কেন বলেছ?’

এবার একটু কড়াভাবে। বুঝলাম ও ঘামতে শুরু করেছে। তবুও কোনো উত্তর দিল না। আমি থাকতে না পেরে গলাটা আরেকটু তুলে দিলাম, ‘বলবে কী কিছু?’

দেখলাম ইন্দিরার চোখে জল চলে এসেছে। ও ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি ইচ্ছা করে বলিনি। এটা আমার একটা রোগ।’

‘রোগ?’ আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ‘তোমার বাথরুমে যেতে গেলে সঙ্গে কাউকে লাগে? আমাকে বলতে। জ্যাঠাকে কেন বলতে গেলে?’

ইন্দিরা কেঁদে উঠল, ‘আস্তে, আস্তে, লেডিস আছে।’

আমি চমকে উঠলাম। ঘরের বাইরে থাকা আমার মা আরো চমকে উঠল। মায়ের হাত থেকে গরম চায়ের কাপ পড়ে গিয়ে ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। আমাদের কথা এগোল না আর। কিন্তু আমার মনে সন্দেহ দানা বেঁধে গেল, কিছু একটা আছে। আমাকে জানতে হবে। ঠিক করলাম একেবারে কম্পানিতে গিয়েই খোঁজ নেব, ম্যানুফ্যাকচারিং ডিফেক্টটা কী, কারণ আমি তো ‘হ্যান্ডেল উইথ কেয়ার’ করেছি।

তাই সে মুহূর্তে আর কিছু বললাম না। ইন্দিরাকে শান্ত করলাম। ওর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি। আমি জ্যাঠামণিকে বুঝিয়ে বলে দেব।’

দুদিন পরে শ্বশুরবাড়িতে গেলাম। আমাকে দেখে শ্বশুরমশাইয়ের কপালে ভাঁজ দেখা দিল। আমি সরাসরি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনার মেয়ের রোগটা কী বলুন তো।’

শ্বশুরমশাই এড়িয়ে যেতে চাইলেন, ‘কী রোগ থাকবে? কিছু তো নেই। তুমি বসো। আমি ইন্দিরার মাকে চা করে আনতে বলি।’

আমি শ্বশুরমশাইয়ের হাত ধরে তাঁকে বসিয়ে দিলাম, ‘পরিষ্কার করে বলুন তো ব্যাপারটা কী। আপনার মেয়ে নিজে আমাকে বলেছে ওর রোগ আছে। কী রোগ সেটা বলেনি। বাড়িতে এমনিতেই অনেক ক্যাচাল হয়ে গেছে। আপনি আর কথা ঘোরাবেন না প্লিজ।’

শ্বশুরমশাই বুঝলেন, পালানোর আর পথ নেই। তিনি আমতা আমতা করে আমাকে সব বললেন। শুনে তো আমার মাথায় হাত। এ রকম আবার হয় নাকি? এ তো প্রথম শুনছি। কেউ থেকে থেকে বাস কন্ডাক্টরের মতো হয়ে যায়! আমি ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম। দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাও এ আবার কি অদ্ভুত রোগ রে বাবা।’

আমি হাজারটা চিন্তা করতে করতে যখন বাড়ি ফিরি তখন দেখি পুরো বাড়ি সুনসান। জ্যাঠারা কেউ বাড়িতে নেই। বাবাও নেই। শুধু এক কোণে আমার মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। আমি ব্যাগ নামিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা কী হয়েছে গো? কাউকে দেখছি না।’

মা কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সবাই অর্পিতাকে নিয়ে নার্সিং হোমে গেছে।’

‘বউদি নার্সিং হোমে’, আমি চমকে উঠলাম, ‘কী হয়েছে?’

মা ফোঁস করে উঠল, ‘কী আবার হবে। তোমার ওই গুণধর বউয়ের জন্য এবার আমাদের বাড়িতে আগুন লাগবে।’

আমি ঢোক গিললাম, ‘কেন, ইন্দিরা আবার কী করল?’

মা যেন আরো খেপে গেল, ‘কী করেছে? অর্পিতা ছাদে রেলিংয়ে ভর দিয়ে কাপড় মেলছিল। তোমার বউ হঠাত্ করে আমার সামনেই ওকে ডেকে বলল, ‘বাঁয়ে বাঁয়ে’। বেচারী অর্পিতা বাঁ দিকে কাত হতেই ধড়াম করে ছাদ থেকে পড়ে গেল। কে জানে কতগুলো হাড় ভেঙেছে!’

আমি আঁতকে উঠলাম। মাকে কী করে বলব, তোমার বউমা জাত কন্ডাক্টর। চুপচাপ কেটে পড়েছি ওখান থেকে।

আপাতত ভাড়া বাড়িতে আছি। বাবা ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। একটা ফ্ল্যাট খুঁজছি। এখানেও বেশিদিন থাকা যাবে না। দুদিন আগেই আমার বউ বাড়িওয়ালীকে জিজ্ঞেস করেছে, ‘কোথায় নামবেন দিদি?