যখন আমার বয়স ছিলো দশ বছর তখন পূর্বের সাথে বিয়েটা হয়।পূর্বের মা আর মামুনি দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো।উনাদের ফ্রেন্ডশিপ রক্ষার্থে বলি হতে হয় পূর্ব আর আমাকে।ছোট বেলা থেকে পূর্বের সাথে আমার সাপ-নেউলের সম্পর্ক।আমাদের পরিবার ভেবেছিলো আমরা বড় হয়ে বিয়ের জন্য রাজী হবো না।একজন আরেকজন ঘৃণা করবো।তই আমাদের বিয়ে নামক বন্ধনে আবব্ধ করে দেয় ছোট বেলায়।তখন আমরা বিয়ে কী সেটা বুঝতাম না।আর না ভালোবাসা নামক কোনো শব্দের সাথে পরিচয় হয়।পূর্ব আমার থেকে দুবছরের বড়।আমার এসএসসি পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর একেবারের জন্য শ্বশুর বাড়ি পাঠানো হয়।মা-বাবা আমাদের দুজনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য একসাথে করে দেয়।কিন্তু আমাদের ঝগড়া আরো বেড়ে যায়।
সে কী ঝগড়া পূর্বের সাথে!এমন একটা দিনও বাদ পড়েনি যেদিন ঝগড়া হয়নি।মাঝেমধ্যে তো রাতে পূর্ব বাড়িতে ফিরতো না।তখন আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারতাম।খাওয়া থেকে ঘুমানো পর্যন্ত ঝগড়াঝাঁটি-রাগারাগি করতাম।কী নিয়ে ওর প্রতি আমার এতো রাগ বুঝে উঠতে পারি না।জন্মের পর থেকে কোনোদিনও ভালো করে কথাই বলিনি।শ্বশুরবাড়িতে দুবছর কাটানোর পরও পূর্বের প্রতি কোনোদিনও আমার অন্যরকম অনুভূতি আসেনি।বরং আমাদের ঝগড়াঝাটিতে পূর্বের মা মানে আমার আম্মি অসুস্থ হয়ে
পড়লো।এতেও আমাদের কোনো পরিবর্তন হয় নিই।দু’জন দুজনকে দোষ দিতে থাকি ছোট-খাটো বিষয়ে। বৃষ্টির দিনে রান্নাঘরে খিচুড়ি আর মাংসের ভোনা করছিলাম।বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।আর এসময় খিচুড়ির সাথে গরুর মাংসের কালো ভোনা খেতে বাড়ির সবাই অনেক ভালোবাসে।আম্মি সুস্থ থাকলে উনিই করতেন কিন্তু সকাল থেকে আম্মির জ্বর বেড়ে গেছে।আর খিচুড়ি খেতে আম্মি বেশিই পছন্দ করেন।তাই ধেরি না করে কাজে লেগে পড়লাম। পূর্ব রোদ হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ পেয়ে আমি দরজা খুলতে গেলাম।বাবাই এসেছে হয়তো।কারণ পূর্ব হলে একাধারে বেল বজাতো।দরজা খুলতেই বর্ষাকালের ভেজা মাঠির গন্ধ নাকে বেঁধে গেলো।চোখ বন্ধ করে সেই সুবাশ অনুভব করলাম।আমার চোখের সামনে বাবাই তুড়ি বাজিয়ে বললো, “হয়েছে মাঠির গন্ধ নেওয়া?আমাকে ঢুকতে দিবি?” “আসো।” বাড়ির ভিতর ডুকে বাবাই বললো, “আমার অতি আদরের পুত্তুর কই?” “তোমার আদের ছেলে কোথায় সেটা আমি জানবো?খবর রাখি আমি তার?কোন মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে সেটা সে জানে।আমাকে কেনো জিজ্ঞেস করো তোমরা জানিনা।….” মাথার রক্ত উঠে গেলো বাবাইের প্রশ্নে।যার সাথে কোনোদিন ভালো করে কথায় বললাম তার খবর আমি জানবো কীভাবে?বাবাই’য়ের সাথে আর কথা না বলে আমি রান্না ঘরে চলে এলাম।আর বাবাই আম্মির সাথে কথা বলতে গেলো।
“শরীর কেমন লাগছে এখন?”
“আলহামদুলিল্লাহ!পূর্ব কোথায়?সকাল থেকে দেখিনি।”
“আমিও তো দেখলাম না।রোদ থেকে জিজ্ঞেস করাই ভাষণ শুনিয়ে দিলো।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে চিন্তিত স্বরে চাঁদনি বললো”আচ্ছা সূর্য ওদের বিয়ে দিয়ে কী আমরা খুব বড় ভূল করেছি?কেউ কাউকে দুচোখে দেখতেই পারে না।জানিনা ওদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে।”
আফসোসের সুরে কথাগুলো বলে পূর্বের মা চাঁদনি চোখ বুঁজে নিলো।উনারা ভেবেছিলেন বিয়ে দিলে হয়তো ওদের মধ্যে যে দূরত্ব আছে সেটা কমে যাবে।কিন্তু হলো তার উল্টো।বাড়িতে প্রতিদিন ঝগড়া লেগেই থাকে।সূর্য মোহাম্মদ মনেমনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।উনার কানে চেচামেচি ভেসে আসছে।তারমানে পূর্ব এসেছে।কে জানে এখন আবার কোন কান্ড করলো?চাঁদনি উঠার চেষ্টা করলে সূর্য বললো,
“চাঁদনি আমি গিয়ে দেখছি।তুমি শুয়ে থাকো।”
“আচ্ছা।”
।
।
“তোকে কতবার বলছি বেল একবার দিবি।হাজার বার বেল দিস কেন?হরিচন্দন!”
“আমার বাড়ি,আমার কলিং বেল,আমি যেমন ইচ্ছে করবো।তুই কে?এতো নাক ঢোকাস কেন?”
“কতোবার বলেছি তোকে ভদ্র ভাষায় কথা বলবি।অশিক্ষিত হরিচন্দন!..”
“নিজে কতো শিক্ষিত?তোকে বলছি না আমি তুই-তোকারি করবি না।!”
“হাজার বার করবো।তুই কোন দেশের প্রেসিডেন্ট যে তোকে সম্মান দিতে হবে?”
“আমার বাড়ির প্রেসিডেন্ট আমি।”
“আইছে!হনুমানের মতো চেহেরা নিয়ে প্রেসিডেন্ট হতে।”
“তুই আমাকে আবার ঐ নামে ডাকিস? আজকেই বাড়িতে চলে যাবো।”
“যা না তো।ধরে রাখছে কে তোরে?ব্যাগ গুছিয়ে দিবো?
“চুপ করো তোমরা!বাড়িতে একটা মানুষ অসুস্থ সেটা কী ভূলে গেছো?পূর্ব তোমাকে তোমার মা ডাকছে।”
সূর্য মোহাম্মদের কথা শুনে দুজনে নরম হয়ে এলাম।কিন্তু পূর্বের উপর থেকে এক বিন্দু রাগও কমলো না।দুজন-দুজনের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে স্থান ত্যাগ করলাম।আমার স্বাদের কালো ভোনা হয়তো পুড়ে গেলো হয়তো!
।
। পূর্ব রোদ
” মা তুমি ডিসিশন নাও।এই বাড়ি হয় ঐ মেয়েটি থাকবে নয়তো আমি।”
“এমন করিস কেন বাবা?কী দোষ মেয়েটার?”
“ও হ্যা।কী দোষ মেয়েটার?ঐ মেয়েটা তো তোমাকে কালো জাদু করেছে!তাই না?নিজের ছেলের দোষ দেখবে এখন।”
“পূর্ব তোমার মা হয় উনি।গলা নিচু করে কথা বলো।”
“সরি বাবা।কিন্তু মেয়েটাকে আমার মোটেও সহ্য করতে পারছি না।”
“মেয়েটা মানে কে?তোমার ওয়াইফ হয় সে।”
“মানি না আমি এই বিয়ে।তোমরা আমাকে জোর করে ঐ মেয়ে আচলে বেঁধে রেখেছো।”
আড়িপেতে বাবাই,পূর্ব আর আম্মির কথা শুনছি।বাবাইকে পূর্ব একটু-আধটু ভয় পাই।এতে আমার সুবিধা বেশি।যখন-তখন সত্যি মিথ্যা বলে বাবাইয়ের বকা শুনাতে পারি।আমার তো এখন লুঙ্গি ডান্স দিতে ইচ্ছে করছে।যখন যা করতে মন চাই তখন তা করে ফেলায় শ্রেয়।আম্মিকে খাবার খাওয়াতে এসেছিলাম।কিন্তু এখন আমার ডান্স করতে মন চাইছে তাই খিচুড়ির প্লেটটা রান্না ঘরে রেখে পূর্বের রুমে গেলাম লুঙ্গি খুঁজতে।রুমে গিয়ে দেখলাম সব কিছু সুন্দরভাবে গুছানো।দেখেই আমার গা জ্বলে উঠলো।আমি মেয়ে হয়ে আমার রুম গোছানো না।আর এই হরিচন্দন ছেলে হয়ে?মাথার মধ্যে একটা সুন্দর বুদ্ধি বাসা বাঁধায় সবকিছু দু’মিনিটের মধ্যে এলেমেলো করে লুঙ্গি নিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম।সাউন্ড বক্সে ফুল ভলিউমে “লুঙ্গি ডান্স” গানটা ছেড়ে,সান গ্লাস চোখে দিয়ে লুঙ্গিটা পড়ে নিলাম।
“লুঙ্গি ডান্স,লুঙ্গি ডান্স,লুঙ্গি ডান্স,লুঙ্গি ডান্স!”
নাচতে নাচতে যখন হাঁপিয়ে এলাম তখন চুপিচুপি লুঙ্গিটা পূর্বের বিছানায় রেখে এলাম।পূর্বের রুমে কোনোকিছু ঠিক নেই এখন।আমার তো ভেবেই হাসি পাচ্ছে যে রুম দেখে হরিচন্দনের রিয়েকশন কেমন হবে।চুপচাপ ভালো মেয়ে সেজে আম্মির জন্য খাবার নিয়ে গেলাম।এখন আমাকে দেখলে সবাই ভাববে ভদ্র মেয়ে আমি!
“আম্মি বারোটা বাজতে চললো।উঠো হালকা কিছু খেয়ে ঔষুধ খাবে।”
পূর্ব প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখছে কী রান্না করেছি।আজ অবধি কোনোদিন আমার রান্না পূর্ব মুখে দেয়নি।কিন্তু যেভাবে লোভার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনে হয় চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবে।হঠাৎ বললো,
“কোন পেত্নী জাদু দিয়ে রেঁধেছে কে জানে।ছিঃ কী বাঝে গন্ধ!ওয়াক!ওয়াক!”
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পূর্ব রুম ত্যাগ করলো।রাগের চোটে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু বাবাই থামিয়ে দিলো।আমিও আর কিছু বললাম না কারণ আসল মজা তো একটু পর হবে।আম্মিকে খাওয়ানো শেষ করে আমি বেরিয়ে আসছিলাম।দরজা খুলতে পাচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বার ষাঁড়ের মাথায় ব্যাথা পেলাম।
“গেলো রেএএএ।আর এতো যত্নে গড়া কিউট কপালটা ষাঁড়ের মাথায় লেগে মান-সম্মান সব হারালো।”
ব্যাথা পাওয়া যায়গায় হাত দিয়ে কচলাতে কচলাতে চোখ তুলে আবারো বললাম,
“তুই চোখে দেখোস না?কারে ধার দিয়া আইলি তোর চোখ?”
“চুপ!তুই আমার রুমে গেছিলি?”
“তোর রুমে যেতে আমার ঠেকা পরে নাই।তোর রুমে যাইতাম কেন আমি?”
পূর্বের রুমে আমি কোনোদিন যায় না।তাই পূর্বের কাছে কোনো প্রমান নেই ওর রুমের ঐ দশা আমি করলাম।
“তাইলে কে গেছিলো আমার রুমে?সকালে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিলাম আর এখন দেখি সব এলেমেলো।”
“তুই রুম গোছানো শুরু করেছিস কবে থেকে?”আধশোয়া অবস্থায় আম্মি প্রশ্ন করলো।সাথে সাথে বাবাই আর আমি ফিক করে হেসে দিলাম।কারন পূর্ব নিজের রুম কোনোদিন গোছায় নিই।সবসময় আম্মি গুছিয়ে রাখতো।গত কয়েকদিন ধরে আম্মি অসুস্থ থাকায় এখন সে নিজে গুছিয়েছে।
“মা আমি সত্যি রুম গুছিয়ে রেখেছিলাম।” পূর্ব রোদ
“তাহলে এলোমেলো কে করবে?রোদ তো সকাল থেকে রান্না করে।আর আমি বাইর থেকে আসলাম তোর আসার আগে।”
“আমি জানি সব এই জাদুমন্ত্রী’র কাজ।কোনো এক ফাঁকে গিয়ে করেছে।”
“মোটেও আমার দোষ দিবি না।তোর রুমে যায় না আমি।”
“লুঙ্গি বের করছে কে আমার রুম থেকে?এক বছর আগে পরতাম আমি লুঙ্গি।সব তুই করছিস।”
“বাবাই তোমার ছেলেকে বুঝিয়ে দাও কোনো মেয়ে লুঙি পরে না।ধ্যাত আমারই টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে পাবনার পাগলের সাথে কথা বলে।সরো তো..সরো.”
পূর্বকে ডিঙিয়ে আমি ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম পূর্ব রেগেমেগে আমার রুমে যাচ্ছে।নিশ্চয় আমার জিনিসপত্র এলোমেলো করতে যাচ্ছে।আমি পায়ের উপর পা দিয়ে পূর্বের পরের কাজের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
।
।
পূর্ব রোদের রুমে গিয়ে দেখে সব কিছু আগে থেকে এলোমেলো।রেগে গিয়ে পূর্ব পাশের ফুলদানি ভেঙ্গে ফেললো।মাঝেমধ্যে পূর্বের ইচ্ছে করে রোদকে খুন করে ফেলতে কিন্তু তার বাবা-মার জন্য তার ইচ্ছাকে চেপেরেখেছে।কেনো যে রোদের সাথে তার বিয়েটা হলো?পূর্ব মনে মনে ঠিক করে নিলো সে পালিয়ে যাবে।
(চলবে)
@ পূর্ব রোদ 🌿
#আমিশা_নূর
বি.দ্রঃভূলক্রটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।কার কাকে ভালো লেগেছে জানাবেন।#রোদ নাকি #পূর্ব